গল্প- উপহার কেচ্ছা

উপহার কেচ্ছা
-লোপামুদ্রা ব্যানার্জী

 

 

বললাম চারাপোনা আনতে আর বাবু হাজির করলেন ইলিশ। আর পারি না বাপু তোমাকে নিয়ে। এত দাম দিয়ে ইলিশ খাওয়ার কোনো মানে হয়!

-গিন্নি এখন মাসের প্রথম সপ্তাহ নিঃশ্চয় খেয়াল আছে। এখন আমার পকেট বেশ গরম বুঝলে।

-তা এতই যখন পকেট গরম তাহলে আমার শাঁখা বাঁধানোটা জুয়েলার্সের কাছ থেকে নিয়ে আসি চল। সেই কবে তৈরি করতে দিয়ে এসেছি। গিয়ে নিয়ে আসা আর হয় না। ওদের দোকান থেকে প্রায়ই ফোন করছে। ওদের কে তো আর বলা যায় না এখন হাত খালি।

গিন্নির শাঁখা বাঁধানোর কথা কথাটা শুনে অশোক বাবু হঠাৎ কেঁচোর মতো গুটিয়ে গেল। একটু দুঃখী দুঃখী ভাব করে বলে, বুঝলে এই মাসে এল আই সি এর প্রিমিয়াম জমা করতে হবে। টাকার অঙ্কটাও তো বেশ বেশি। তারপর বাবলি, বুবাই এর কলেজের নিত্য নতুন খরচা লেগেই আছে। ছোট মাসির মেয়ের বিয়ে লেগেছে। সেখানেও মোটা খরচা। তাই বলছিলাম এই মাসে তোমার শাঁখা বাঁধানোটা জুয়েলার্সের কাছেই থাক। সামনের মাসের দশ তারিখের মধ্যে আমি নিজে গিয়ে তোমার গয়না আনবো।

সুলতা দেবী মুখটা বেঁকিয়ে বলে, থাক তোমাকে আর দুনিয়ার দরকারি হিসাব আমাকে শোনাতে হবে না। সবার সব কিছুতেই তুমি মুক্ত হস্ত। শুধু মাত্র আমার বেলায় তোমার পকেট গড়ের মাঠ।

এই বলে দুমদাম করে পা ফেলে ইলিশ মাছগুলো পেঁথেতে নিয়ে ধুতে চললো কলতলায়। রান্না ঘরের বেসিনে মাছ ধোওয়া একদম পছন্দ নয় সুলতা দেবীর। বেসিনে মাছ ধুলে নাকি সারা বেসিন ময় বিশ্রী গন্ধ হয়ে যায়।

বুবাই আর বাবলি ঘরে বই খাতা নিয়ে পড়তে বসলেও বাবলি কিন্তু কানখাড়া করে মা বাবার ঝগড়া শুনছিল এতক্ষণ। সে বিজ্ঞের মতো বলে, দাদাভাই এই শুরু হল রোজকার ড্রামা। উঃ পারেও বাবা এরা। কি করে যে রাতে ঝগড়া না করে ঘুমায় একসাথে কে জানে?

বুবাই বলে, রাতেও বিছানায় মা আর বাপি যুদ্ধ করে সেটা জানিস কি তুই? আরে সেদিন মা মনিকে বলছিল, বুঝলি ববি তোর অশোকদার সাথে আর এক ঘরে থাকা যাবে না।

বাবলি প্রচন্ড আগ্ৰহ ভরে বলে, তারপর, তারপর?

-মনি ওপার থেকে কি বলছিল সেটা তো শোনা যায় না। জানিস তো মা স্পিকারে দিয়ে কোনো কথা বলতে চায় না মামাবাড়ির লোকজনদের সঙ্গে। শুধু মাত্র যখন ঠাম, পিপি ফোন করে তখন তাড়াতাড়ি করে ফোনটা স্পিকারে দেয়। যাতে ওদের কথা আমরা সবাই শুনতে পারি।

বাবলি চিন্তিত মুখে বলে, তাহলে তুই জানতে পারলি না মা বাপির রাতের বেলায় অশান্তির কারণটা। জানিস দাদা, সেদিন মোবাইলে দেখছিলাম একজন ভদ্রলোক বিয়ের পঁচিশ বছর পরও অন্য মেয়ের প্রেমে পড়ে যাচ্ছে।

বুবাই ধমকের সুরে বলে, তার মানে তুই কি বলতে চাইছিস ? অন্য কোনো মহিলাকে নিয়ে মা-বাপির মধ্যে অশান্তি। তুই না তোর এই বস্তা পচা সিরিয়ালগুলো দেখা বন্ধ কর এবার। যতসব base less কথাবার্তা।

বাবলি উল্টে বিরক্ত হয়ে বলে, for your kind information আমি মোবাইলে প্যানপ্যানে সিরিয়াল দেখি না। আমাদের জেনারেশন এখন ওয়েব সিরিজ দেখে। আর তুই ভাবিস না আমি বিনা কারনে বাপিকে সন্দেহ করছি।
-প্রমাণ! কি প্রমাণ শুনি?
-দুদিন আগে আমার বান্ধবী কুজ্ঞা টিউশনিতে আমায় জিজ্ঞেস করে, কি রে তোর মা বাবার marriage anniversary কেমন কাটলো? কাকু কিন্তু দারুণ একটা রোমান্টিক স্ট্যাচু গিফট করেছে কাকিমা’কে তা আমি জানি। কি সুন্দর কাঁচের বলের মধ্যে একটা ছেলে ও একটা মেয়ে পুতুল ঘুরছে। আবার কি সুন্দর একটা রোমান্টিক মিউজিকও বাজছে।
দাদাভাই তোকে কি বলবো, আমি তো কুঞ্জার কথা শুনে আকাশ থেকে পড়লাম।প্রথম কথা মা বাপির বিবাহ বার্ষিকী সেই জানুয়ারি মাসে আর কস্মিনকালেও দেখলাম না ওরা বিবাহ বার্ষিকী পালন করছে। দ্বিতীয়, বাপি মা’কে কিছু দিলে মা অবশ্যই আমাদের দেখাতো। তাহলে এখন প্রশ্ন হলো বাপি গিফটটা কার জন্য কিনলো?

বুবাই সব শুনে বলে, দেখ বোন হয়তো বাপির অফিসের কোনো কলিগের বিবাহ বার্ষিকীর অনুষ্ঠান আছে তাই বাপি গিফটটা কিনেছে।

বাবলি উত্তেজিত হয়ে বলে, তোর কি মনে হয় বাপি তার বন্ধু বান্ধব দের দামী গিফট দেবে? এখনও খামে ভরে একশো এক টাকার বেশি কোনো অনুষ্ঠান বাড়িতে বাপি গিফট দেয় না।

তারপরই খুব দুঃখী দুঃখী মুখ করে বলে, হ্যাঁ রে দাদাভাই মা জানতে পারলে কত খানি দুঃখ পাবে একবার ভেবে দেখেছিস। যদি বিষয়টা জানাজানি হয়ে যায় তাহলে আমরাই মুখ দেখাবো কি করে?

বুবাই এবার প্রচন্ড রেগে গিয়ে বলে, তোকে এবার টেনে এক থাপ্পড় লাগাবো। ওয়েব সিরিজ দেখে দেখে মাথাটা একেবারে খারাপ হয়ে গেছে। এই গিফটের বিষয় নিয়ে মাকে কিন্তু কিচ্ছুটি বলবি না একদম। তোর আবার যা পেট পাতলা স্বভাব।

আপাতত অশোক বাবুর রোমান্টিক গিফট কেনার অধ্যায়টা বন্ধ করে ভাই-বোনে। দুপুরে জমিয়ে সাদা সরষে বাটা দিয়ে ইলিশ মাছের ঝাল বাটনা খেয়ে বাড়ি সুদ্ধ লোক খুব খুশি। অশোক বাবু খেতে বারবার বলে উঠছিলেন, বাবলি, বুবাইকে কিন্তু দু’ পিস করে মাছ দিও। আমাকে এক পিস দিলেই হবে। তোমার জন্য কিন্তু বড় পিসটা আগে তুলে রাখো।

সুলতা দেবী এবার মুখ ঝামটা দিয়ে ওঠে, পরিবেশন যখন আমি করছি তখন আমি বুঝবো কাকে কি দিতে হবে। তুমি এতো বকবক করছো কেন? তাহলে এবার থেকে তুমিই ছেলে মেয়েকে খেতে দিও।

বাবলি খেতে খেতে বলে, মা ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে কচুশাকটা কিন্তু বেশ ঝাল ঝাল করে রান্না করো।

সুলতা দেবী বাবলির মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, ঠিক আছে তাই হবে। আগামীকাল তো সেকেন্ড হাফে কলেজ যাবি। তাহলে গরম গরম খেয়েও যেতে পারবি।

-না না। কলেজ যাওয়ার আগে মাছ খাবো না। মুখে কেমন একটা গন্ধ লাগে। তার থেকে ভালো রাতে আরাম করে খাবো।

দুপুরে খাওয়া দাওয়া সারা হলে রান্নাঘর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে সুলতা দেবী নিজের ঘরে এসে দেখে তার পতিদেবতাটি আজ নাক ডাকিয়ে দিবা নিদ্রা না দিয়ে মোবাইলে গান শুনছেন ইয়ার ফোনটা কানে গুঁজে।

সুলতা দেবী মৌরি চিবাতে চিবাতে বললো, কি ব্যাপার বাবুর আজকে এতো খোশমেজাজ?

অশোক বাবু তাড়াতাড়ি ইয়ার ফোনটা কান থেকে খুলে সুলতা দেবীর কানে গুঁজে দিল।’ এক বৈশাখে দেখা হলো দুজনার, জৈষ্ঠ্যতে হলো পরিচয়। আসছে আষাঢ় মাস মন তাই ভাবছে কি জানি কি হয়?’ এই গানটা শুনে সুলতা দেবী বলে এতো ‘বিলম্বিতলয় ‘ছবির গান সুপ্রিয়া দেবীর লিপে।

-ওগো তোমার কি মনে নেই আমাদেরও বিয়ের কথা ফাইনাল হয়েছিল আষাঢ় মাসের তেরো তারিখে।

-তা আবার মনে নেই। Unlucky thirteen -কি unlucky? ওওওও আমি বুঝি তোমার জন্য unlucky?
-বিয়ে করে যে আমার luck টাই কোথায় চলে গেল আজও টের পেলাম না।
-সে তুমি যাই বলো। তুমি কিন্তু আমার জীবনের সবচেয়ে লাকি বস্তু।
-বাঃ বাঃ, বউ হল কি না বস্তু!
-আরে বাবা চটছো কেন? আমি তোমাকে বস্তু বলতে চাই নি।
-দেখো বাপু সকাল থেকে অনেক খাটাখাটনি হয়েছে। তুমি তোমার স্মৃতিচারণ বন্ধ করো এবার। আমাকে একটু গড়িয়ে নিতে দাও।এই বলে সুলতা দেবী পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো।

অশোক বাবু সুলতা দেবীর কানের কাছে একটা মিষ্টি রোমান্টিক মিউজিক চালায়। সুলতা দেবী মুখ ঘুরিয়ে দেখে একটা কাঁচের বলের মধ্যে একটি ছেলে ও মেয়ে পুতুল হাত ধরে নাচছে। সুলতা দেবীর মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে, কি সুন্দর গো!

তা এটা কার জন্য কিনলে গো? তোমাদের অফিসের কারোর বিবাহ বার্ষিকী আছে নাকি?

অশোক বাবু প্রেমে গদগদ হয়ে বলে, এটা তোমার গিফট। আমি তো খরচের ভয়ে সেভাবে কোনদিন বিবাহ বার্ষিকী কিংবা তোমার জন্মদিন পালন করি নি। তাই কদিন ধরে ভাবছিলাম আষাঢ় মাসের তেরো তারিখটা এলে তোমাকে একটা উপহার দেবো। কতদিন শুধু মাত্র তোমার জন্য কিছু কিনি না।

সুলতা দেবী বিছানাতে উঠে অশোক বাবুর কাঁধে মাথাটা রেখে বলে, আটাশটা বছর পেরিয়ে গেলেও সেদিনের তোমার লাজুক চাহনিটা আজও আমার মনে পড়ে। তখন এই রকম টেকো মাথাটা ছিল না। ছিল মাথা ভর্তি চুল ঠিক রাজেশ খান্নার মতো।

-তাই বুঝি, আমাকে ইয়ং বয়সে রাজেশ খান্নার মতো লাগতো। কই তুমি তো কোনোদিন সেকথা বল নি। ভাগ্যিস আজ এই রোমান্টিক স্ট্যাচুটা তোমার জন্য কিনে আনলাম। তাই তো তোমার মনের কথা জানতে পারলাম।

সুলতা দেবী মুচকি হেসে বলে, থাক অনেক হয়েছে। বুড়ো বয়সে আর আদিখ্যেতা করতে হবে না। ছেলে মেয়েদের এখন প্রেম করার বয়স। আমাদের নয় গো।
-সে কি গো গিন্নি প্রেমেরও আবার বয়স আছে নাকি?
-আছে মশাই আছে। প্রেমেরও বয়স আছে। তুমি যে আমাকে এত সুন্দর এই শো-পিসটা দিলে টাকা খরচা করে সেটা যদি আমি বাবলি বুবাইকে দেখাই তাহলে ওরা তো পিছনে হাসাহাসি করবেই। তোমার যখন এতই উপহার দেওয়ার ইচ্ছা করছিল আমাকে বলতে পারতে একবার। আমার অনেক দিনের একটা স্টিলের চাকি বেলনের সখ ছিল। ওটা দিলে আমার কাজেও লাগতো আর আমাকে তোমার উপহারটা লুকিয়ে রাখতে হত না।

এই বলে তাড়াতাড়ি গিফটটা বক্সের মধ্যে ঢুকিয়ে আলমারির লকারের একদম ভিতরের দিকে রেখে দিল।

অশোক বাবু রাগ করে বললেন, লুকিয়ে রাখার কি হয়েছে? তোমার সবেতেই বাড়াবাড়ি। এইজন্যই কিছু আনতে ইচ্ছে করে না ভালোবেসে। তারপর কোলবালিশটা টেনে পিছন ফিরে দেওয়ালের দিকে মুখ করে শুয়ে পড়লেন।

দিন পনেরো পর বাবলি কি একটা দরকারি কাগজের খোঁজে আলমারির লকারটা খোলে। সুলতা দেবী আলামারি কেনার পর থেকেই লকারেই দরকারি কাগজ পত্র রাখে।লকারে রাখার মতো গয়না তো আর তার নেই তাই মূল্যবান কাগজ দিয়েই ভরে রাখেন সেটা।

বাবলি লকারের ভিতরে একদম কোণের দিকে একটা ছোট বক্স দেখতে পায়। তাড়াতাড়ি করে সেটা টেনে বের করে খুলে দেখে তো সে হতবাক। হুবহু কুঞ্জার দেওয়া বিবরণ মিলে যাচ্ছে।

বাবলি ভাবে তাহলে কি বাবা এটা লকারের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছে একদম কোণে। যাতে মায়ের নজরে না আসে। লকার তো আর মা নিত্য খোলে না। সে তাড়াতাড়ি গিফটটা যথাযথ ভাবে প্যাক করে যথাস্থানে রেখে দিয়েই ছুটলো বুবাই এর কাছে। বুবাই সেদিন ইউনিভার্সিটি যায় নি। বাবলি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে তাকে গোটা বিষয়টা জানায়। বুবাইও বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ে। সন্তান হয়ে বাবার কেচ্ছা মাকে বলতে লজ্জা করছিল বাবলির। তাই বাবলি তার ছোট মাসি ববিতাকে ফোন করে সব জানায় এবং বিকালে ডেকে পাঠায়।

ববিতাও তড়িঘড়ি করে বিকাল পাঁচটার মধ্যে এসে হাজির। কারণ সে জানে জামাইবাবুর অফিস থেকে ফিরতে ছটা সাড়ে ছটা বেজে যায়। সুতরাং নিশ্চিন্তে দিদির সাথে কথা বলা যাবে জামাইবাবুর বিপথ গামী হওয়াকে কেন্দ্র করে।

দুই বোনে একদম দরজা বন্ধ করে আলোচনা সভা বসায়। বাবলি বুবাই বারবার দরজায় আড়ি পেতে চলেছে। কিন্তু হতাশ হয়ে ফিরে আসছে।
বাবলি বুবাইকে বলে, বুঝলি দাদাভাই মা মাসিমনির কাছ থেকে উপহার কেনার বিষয়টা জানার পর আজ আর বাপিকে আস্ত রাখবে না।

তা প্রায় এক ঘন্টা পর সুলতা দেবীকে দরজা খানা খুলে চুপচাপ বেরিয়ে এলেন। একবার ঘাড় ঘুরিয়ে ছেলে মেয়েগুলোর মুখের দিকে তাকালেন। তারপর রান্না ঘরে চলে গেলেন।

বুবাই, বাবলি তার ছোট মাসিকে চেপে ধরে জানতে চাই তার মায়ের প্রতিক্রিয়ার কথা। ববিতা মুচকি হেসে বলে, তোদের বাপিকে নতুন করে প্রেম রোগেতে ধরেছে বুঝলি।

বাবলি তৎক্ষণাৎ বিজ্ঞের মতো বলে, দেখলি দাদাভাই আমার সন্দেহ খানা একদম ঠিক।

সুলতা দেবী গ্যাস ওভেনে চা-এর জল চাপাতে চাপাতে তার ছেলে মেয়ের কান্ড কারখানা ভাবছেন আর মুখ টিপে টিপে হেসে চলেছেন। নিজের মনেই বলতে থাকে, আমাদের দাম্পত্য প্রেম বোঝা কি এত সহজ ব্যাপার! সারাদিন আমরা ঝগড়া করি বলে কি আমাদের ভিতরের ভালোবাসা শেষ হয়ে গেছে! দম্পতিদের ভালোবাসা অনেকটা ফল্গুধারার মতো লুকিয়ে থাকে মনে।

Loading

2 thoughts on “গল্প- উপহার কেচ্ছা

Leave A Comment